ব্যবসায়ের আওতা বা পরিধি

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ১ম পত্র | | NCTB BOOK

অভাব পূরণের প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার উৎপাদন ও বণ্টন এবং এর সহায়ক যাবতীয় কার্যাবলি ব্যবসায়ের আওতাভুক্ত। অর্থাৎ উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ হতে আরম্ভ করে তৈরি পণ্য বা সেবা ভোক্তার হাতে পৌছানো পর্যন্ত সকল কার্যাবলিই ব্যবসায়ের আওতা বা পরিধির অন্তর্ভুক্ত। 

শিল্প (Industry)

শিল্প উৎপাদনের বাহন। যে কর্ম প্রচেষ্টা বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং এর উপযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের ব্যবহার উপযোগী পণ্য প্রস্তুত করা হয় তাকে শিল্প বলে। শিল্পের বৈশিষ্ট্য সমূহ—

  1. শিল্প পণ্যদ্রব্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে সম্পৃক্ত;
  2. সম্পদ বা মূল্য উৎপাদনই শিল্পের মূল লক্ষ্য ;
  3. শিল্প পণ্যের আকারগত উপযোগ সৃষ্টি করে; 
  4. শিল্পে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী মানুষের অভাব মোচনের কাজে নিয়োজিত;
  5. অর্ধ প্রস্তুত পণ্যকে চূড়ান্ত পণ্যে রূপান্তরিত করে।

শিল্পকে নিম্নোক্ত বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—

ছক: ব্যবসায়ের আওতা।

ক. প্রাথমিক শিল্প (Primary Industry)

প্রাথমিক শিল্পে কোনো রূপগত পরিবর্তন ঘটে না । প্রাথমিক শিল্পকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে ।

  • প্রজনন শিল্প (Genetic Industry): যে শিল্পে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রি পুনঃবার সৃষ্টি বা উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয় তাকে প্রজনন শিল্প বলে। উদাহরণ স্বরূপ মৎস চাষ, নার্সারি, হাঁসমুরগি, ফলমূল ও গবাদি পশুর খামার।
  • নিষ্কাশন শিল্প (Extractive Industry): ভূ-গর্ভ, নদী, সাগর বা ভূমি থেকে প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদ আহরণ, উপযুক্ত কাজের পরিবেশ, উন্নতমানের পণ্য ও সেবা পরিবেশন ইত্যাদির মাধ্যমে আহরণের কাজে যে শিল্প সম্পর্কযুক্ত তাকে নিষ্কাশন শিল্প বলে ।  উদাহরণস্বরূপ সমুদ্র হইতে মৎস শিকার ও জলজ সম্পদ সংগ্রহ, বন হতে কাঠ বা অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ, নদী হইতে বালু ও ভূ-গর্ভ হতে খনিজ পদার্থ উত্তোলন ইত্যাদি ।
  • কৃষিজ শিল্প (Agricultural Industry): যে প্রক্রিয়ায় কৃষিজ পণ্য উৎপাদন ও আহরণ করা হয় তাকে কৃষিজ শিল্প বলে । উদাহরণস্বরূপ ধান ও পাটের কথা বলা যায় ।

খ. গৌণ শিল্প (Secondary Industry) 

যে প্রক্রিয়ায় সম্পদের রূপের পরিবর্তন ঘটে তাকে গৌণ শিল্প বলে । নিম্নে গৌণ শিল্পের সম্ভাব্য আওতাগুলো তুলে ধরা হলো—

  • উৎপাদন বা প্রস্তুত শিল্প (Productive Industry): শ্রম ও যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাঁচামাল বা অর্ধ প্রস্তুত দ্রব্যকে মানুষের ব্যবহার উপযোগী পণ্যে প্রস্তুত করার প্রচেষ্টাকে উৎপাদন শিল্প বলে। অর্থাৎ পণ্য উৎপাদনের জন্য পণ্যের যে রূপগত পরিবর্তন সাধিত হয় সেই প্রক্রিয়াই হলো উৎপাদন শিল্প । যেমন- গাছ কেটে আসবাবপত্র তৈরি, বয়ন শিল্প, ইস্পাত শিল্প ইত্যাদি ।
  • বিশ্লেষণমূলক শিল্প (Analytical Industry): এ জাতীয় শিল্পে কোনো দ্রব্যকে বিশ্লেষণ করে নানা রকম দ্রব্য তৈরি করা হয়। যেমন-অশোধিত খনিজ তৈল থেকে ডিজেল, পেট্রোল, গ্যাসোলিন, কেরোসিন, খনিজ কয়লা হতে কোক কয়লা,, ন্যাপথালিন, আলকাতরা ইত্যাদি তৈরি করার কাজ ।
  • প্রক্রিয়াভিত্তিক শিল্প ( Processing Industry): এ জাতীয় শিল্পে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে পণ্য উৎপাদন করা হয়। অর্থাৎ প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করার শিল্পই হলো প্রক্রিয়াভিত্তিক শিল্প। যেমন-তুলা হতে বস্ত্র, আখ হতে চিনি ইত্যাদি ।
  • যৌগিক শিল্প (Synthetic Industry): এ শিল্পে একাধিক মৌলিক দ্রব্যের সমন্বয়ে একটি নতুন দ্রব্য তৈরি হয়। যেমন-সার শিল্প এটি কয়েকটি মৌলিক উপকরণের মধ্য দিয়ে সারে পরিণত হয়েছে। সাবান, সিমেন্ট ইত্যাদি যৌগিক শিল্পের উদাহরণ।

গ. সংযোজন শিল্প (Assembling Industry)

এ প্রক্রিয়ায় একাধিক যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ সংযোজন করে নতুন পণ্য তৈরি করা হয়। যেমন-মোটর শিল্প, রেল ইঞ্জিন।

  • সংযুক্ত শিল্প (Integrated Industry): যে শিল্প ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের শিল্প প্রক্রিয়ার একই সাথে সমন্বয় ঘটে তাকে সংযুক্ত শিল্প বলে । যেমন-লৌহ ও ইস্পাত শিল্প ।
  • নির্মাণ শিল্প (Constructive Industry): যে প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে তাকে নির্মাণ শিল্প বলে। যেমন-রাস্তা ঘাট, দালানকোঠা, বাঁধ, সেতু ইত্যাদি নির্মাণ ।
  • সেবা পরিবেশক শিল্প ( Service Industry): যে শিল্প জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত হয়ে থাকে তাকে সেবা পরিবেশক শিল্প বলে। যেমন-পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোন ইত্যাদি সরবরাহ এ শিল্পের আওতাভুক্ত ।

বাণিজ্য (Commerce)

শিল্পে উৎপাদিত পণ্য প্রকৃত ভোগকারীর নিকট অথবা কাঁচামাল ও অর্ধ প্রস্তুত পণ্য পরবর্তী ভোগকারী বা উৎপাদকের নিকট পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল প্রতিবন্ধকতাকে দূরীকরণের জন্য গৃহীত যাবতীয় কাজের সমষ্টিকে বাণিজ্য বলে ।

বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ (Features of Commerce):

১. পণ্য সংগ্রহ ও বণ্টন: পণ্য উৎপাদন হয় এক স্থানে এবং ভোগ হয় বিভিন্ন স্থানে । বাণিজ্য ব্যবসায়, পরিবহণ, গুদামজাতকরণ, বীমা, ব্যাংকিং ও প্রচার ব্যবস্থার মাধ্যমে ঐ সমস্ত পণ্য সংগ্রহ করে বণ্টন করে ।
২. উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে সমন্বয়: বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় উৎপাদন ও বণ্টনের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে বাণিজ্য বাজার স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে ।
৩. ব্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ: বাণিজ্য ব্যবসায়, পরিবহণ, গুদামজাতকরণ, ব্যাংক, বীমা ও প্রচারের দ্বারা যথাক্রমে ব্যবসায়ের ব্যক্তিগত, স্থানগত, কালগত, অর্থ সংক্রান্ত, ঝুঁকিগত বাধা বা প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসায়কে চলতে সাহায্য করে ।
৪. পণ্যের মান ও গুণ উন্নতকরণ ও সংরক্ষনঃ পণ্যের মান ও গুণ উন্নতকরণ এবং সংরক্ষণের লক্ষ্যে
বাণিজ্য প্রমিতকরণ, পর্যায়িতকরণ, চিহ্নিতকরণ, মোড়কিকরণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে ।
৫. বৃহদায়তন উৎপাদনে সাহায্য: বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় পণ্যের বাজারজাতকরণ নিশ্চিত হয় বলে উৎপাদক অবিরত উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত থেকে বাজারের চাহিদানুযায়ী ব্যাপক আকারে উৎপাদন করতে পারে ।

বাণিজ্যের প্রকারভেদ নিম্নরূপ—

বিনিময় (Trade): পণ্য দ্রব্য বা সেবা সামগ্রির স্বত্ব হস্তান্তরের কাজকে পণ্য বিনিময় বলে। বিনিময়ের মাধ্যমে স্বত্ব হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ব্যক্তিগত বাধা অপসারিত হয়। পণ্য বা সেবা বিনিময়কে নিম্নোক্ত কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ।

১. অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য (Home Trade): একটি দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে যে ক্রয় - বিক্রয় কার্য সম্পাদিত হয়, তাকে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বলে । অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকে প্রকৃতি অনুযায়ী আবার দুভাগে ভাগ করা হয়েছে।
i. পাইকারী ব্যবসায় (Whole sale trade): যে ব্যবসায় পাইকারি ব্যবসায়ী উৎপাদকের নিকট হতে অধিক পরিমাণে পণ্য দ্রব্য ক্রয় করে সেগুলো ছোট ছোট লটে খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে তাকে পাইকারি ব্যবসায় বলে ।
ii. খুচরা ব্যবসায় (Retail trade): খুচরা ব্যবসায়ী পাইকারদের নিকট থেকে পণ্য দ্রব্য সংগ্রহ করে সেগুলো ভোক্তাদের নিকট বিক্রি করে । এরূপ ব্যবসায়কে খুচরা ব্যবসায় বলে ।
২. আন্তর্জাতিক/বৈদেশিক বাণিজ্য (Foreign trade): এক দেশের সাথে অন্য দেশের বাণিজ্য হলে তাকে বৈদেশিক বাণিজ্য বলে। এ ব্যবস্থায় এক দেশের ক্রেতা অন্য দেশের বিক্রেতার সাথে বাণিজ্য করে থাকে । বৈদেশিক বাণিজ্য তিনটি উপায়ে হয়ে থাকে—
i. আমদানি (Import): অন্য দেশ থেকে পণ্য কিনে নিজ দেশে নিয়ে আসার কাজকে বলে আমদানি । 

ii. রপ্তানি (Export): রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্য দ্রব্য বা সেবা স্বদেশ থেকে বিদেশে প্রেরণ করা হয় ।
iii. পুনঃরপ্তানি (Re-export): এক দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য তৃতীয় দেশে বিক্রি করা হলে তাকে পুনঃরপ্তানি বাণিজ্য বলে ।

চিত্র: পুনঃরপ্তানি ।

সহায়ক কার্যাবলি (Auxilaries to trade):

মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে শিল্প ও বাণিজ্যে সহায়তা দানের লক্ষ্যে যেসব কার্য সম্পাদিত হয় সেগুলোও ব্যবসায়ের আওতাধীন ।

সহায়ক কার্যাবলি নিম্নরূপ—

i. ব্যাংকিং (Banking): ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সরবরাহ করে ব্যবসায়ের অর্থ সংস্থানজনিত প্রতিবন্ধকতা দূর করে ।

ii. বিমা (Insurance): ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ঝুঁকি সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সহায়তা করে বিমা ।

iii. পরিবহন (Transportation): পরিবহন পণ্য স্থানান্তরের ক্ষেত্রে স্থানগত প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত করে থাকে। পরিবহন তিন উপায়ে হয়ে থাকে-স্থল পথে, জল পথে, বিমান পথে ।

iv. গুদামজাতকরণ (Warehousing): এ প্রক্রিয়ায় পণ্য কিছু সময়ের জন্যে মজুত রেখে সময়গত উপযোগ সৃষ্টি করা হয়।

v. প্যাকিং (Packing): পণ্য বাজারজাতকরণের আগে পণ্যের দাম, গুণ, তারিখ ইত্যাদি সংবলিত একটি আকর্ষণীয় মোড়কে পণ্যকে সাজানো হলে একে প্যাকিং বলে।

vi. বাজারজাতকরণ প্রসার (Promotion): পণ্যের সঠিক মূল্যায়ন হওয়ার জন্য, যে উদ্দেশ্যে পণ্য তৈরি করা হয়েছে এবং মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পণ্যকে বাজারজাতকরণ করা হয়। বাজারজাতকরণের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিষয় হলো-পণ্য গবেষণা, বাজার গবেষণা, বিক্ৰয়িকতা।

প্রত্যক্ষ সেবা (Direct Services)

অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে যেসব কার্য সরাসরি সম্পাদিত হয় কিংবা দৈহিক বা মানসিক শ্রমের বিনিময় করা হয় তাকে প্রত্যক্ষ সেবা বলে।

চিত্র: প্রত্যক্ষ সেবা

প্রত্যক্ষ সেবার বৈশিষ্ট্য:
১. অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্য স্বাধীন পেশায় নিয়োজিত থাকে,
২. পণ্য ছাড়া সরাসরি সেবা প্রদান,
৩. সেবাদাতা ও সেবা গ্রহীতার উপস্থিতি থাকতে হয় ।

প্রত্যক্ষ সেবার আওতা বা প্রকারভেদ

যেসব কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ সেবার মধ্যে পড়ে সেগুলো হলো-চিকিৎসা বৃত্তি, আইন বৃত্তি, হিসাব বৃত্তি, প্রকৌশলী বৃত্তি, পরামর্শ বৃত্তি, হোটেল, সেলুন, নাট্যশালা, সিনেমা হল, অভিনেতা, অভিনেত্রীদের অভিনয়, ডাক্তাররা মিলে ক্লিনিক ব্যবসা বা কয়েকজন উকিল মিলে এটর্নি ফার্ম বা প্রকৌশলীরা মিলে ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম গঠন করতে পারেন; যা প্রত্যক্ষ সেবা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সঙ্গত কারণে ব্যবসায়ের আওতায় আসে । পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যবসায়ের আওতা অত্যন্ত ব্যাপক। বর্তমান বিশ্বে ব্যবসায় একটি ব্যাপক আওতাবিশিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমষ্টি। মানুষের অফুরন্ত অভাব পূরণের জন্য বস্তুগত ও অবস্তুগত সেবা ও শ্রমের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। কাজেই মানুষের এসব চাহিদা পূরণের জন্য অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে সম্পাদিত যাবতীয় কার্যই ব্যবসায়ের আওতাভুক্ত ।

Content added || updated By
Promotion